আমাদের সমাজে পুরুষ এবং নারী বাদে আরও এক লিঙ্গের মানুষদের বসবাস করতে দেখা যায়।
রাস্তায় তারা প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। তারা নপুংসক।প্রকৃতির আজব খেয়ালে তারা সবচেয়ে সংখ্যাগুরু দুই লিঙ্গের কোন একটি লিঙ্গের অংশ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মায়নি।
নব্য সভ্যতার অন্যতম শিক্ষা হলো সংখ্যালঘুকে এক কোণে ঠেলে দেয়া। আর নপুংসকেরা তো সংখ্যালঘুরও সংখ্যালঘু। কাজেই সবার থেকে লাথি ঝাঁটা খেয়ে এসে কোন সংখ্যালঘু এদেরকেও আরেকটা লাথিটা-ঝাটাটা মারতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজেও আমরা এই সভ্যতা খুব চমৎকারভাবে অনুসরণ করে আসছি বলে আমরা সংখ্যালঘু নপুংসকদের এমন কোণঠাসার কোণঠাসা করেছি যে সমাজে আজ তাদের কোন স্থান নেই। তাদের শিক্ষার নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই,স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই,সোজা কথা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তাদের প্রতি আমাদের সমাজের সংগঠিত একটি ভীতি এবং বিতৃষ্ণা আছে । দুঃখজনক হলেও সত্য,এই ভীতি আর বিতৃষ্ণা বেঁচে তারা জীবিকা উপার্জন করে এবং তাদের বেঁচে থাকার আর কোন-ই বিকল্প নেই আর এই বিকল্পহীনতার জন্য কোনভাবেই তারা দায়ী নয়।
তবু আমরা কথ্য ভাষায় এই নিতান্ত নিরুপায়,অসহায় এবং দুঃখী নপুংসকদের হিজড়া বলে ডাকি এবং একইসাথে তাদের পরিচয় টেনে এই হিজড়া শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করি। আমি এই তথ্য খুব কাছের থেকে জানি কেননা কয়দিন আগে 'পুরুষ হয়েও নারীদের পক্ষ নিয়ে লেখা' একটি প্রবন্ধের কারণে আমাকে এই গালিটি শুনতে হয়েছে।
অথচ হিজড়া শব্দটির শাব্দিক উৎপত্তিস্থল অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ নপুংসক নয়। এটি একটি প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় ভাষা 'কান্নাড' থেকে উৎপন্ন এবং শব্দটি আসলেই একটি গালিবাচক শব্দ। এই শব্দের অর্থ হলো অক্ষম বা কাপুরুষ-অর্থাৎ ভীতু।
কিন্তু আজই একটি সংবাদ চোখে পড়লো এবং আমি নিশ্চিত যে সবারই চোখে পড়েছে। তা হলো-একজন মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলে পালানোর সময়ে দুইজন খুনিকে কয়েকজন নপুংসক মিলে তাকে জাপটে ধরে থামিয়ে দিয়েছিলো। মনে রাখবেন,খুনিদের হাতে ছিলো ধারালো রক্তাক্ত ধারালো অস্ত্র আর তারা নিজেরা ছিলো নিরস্ত্র। তারপরও তারা সাহস করে খুনিদের পথ রুখে দেয়।
একই কায়দায় একই রকম আরেকটি হত্যাকান্ড কিছুদিন আগে ঘটে গেছে দেশের প্রাণকেন্দ্র টিএসসিতে। সেখানেও হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে একজন মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তার স্ত্রীকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। টিএসসি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন আর সেই এলাকার মানুষদের মনে করা হয় সবচেয়ে সাহসী মানুষ। এরাই একসময় দেশের জন্যে রক্ত দিয়েছে আর দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। সেই তাদের সামনে যখন এমন একটি ঘটনা ঘটে যায়,তাদের থেকে একজনও সামনে আগায় না,হত্যা থামানোর চেষ্টা করেনা।
এমন একটা পরিস্থিতিতে যদি আমি অক্ষম কাপুরুষ অর্থে হিজড়া শব্দটি ব্যবহার করতে চাই,তবে আমার কার ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যবহার করা উচিত?
কয়েকদিন আগে খুব কাছের একজন মানুষের সাথে আলোচনা হচ্ছিল যে এই মুহুর্তে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হলে কি হতো?আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম যে-এই মুহুর্তে যদি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হতো তাহলে সবাই তাড়াতাড়ি ফেসবুকে লগইন করে প্রথমে যুদ্ধের সপক্ষে একটা স্ট্যাটাস দিতো। সাথে সাথে পুরো নিউজফিড মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মার্কা একটা স্ট্যাটাসের জোয়ারের বন্যায় ভেসে যেত।
চারিদিকে দেখা যেতো- #বীর_বাঙ্গালি_অস্ত্র_ধরো
কাজেই কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা মেইনস্ট্রীম মনে করে কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করতো।এদের মধ্যে থাকতো দুই পার্টি-এক পার্টি ডাইরেক্ট রাজাকার,আরেক পার্টি ইনডাইরেক্ট রাজাকার ওরফে সুশীল। ডাইরেক্ট রাজাকাররা বলতো মুক্তিযুদ্ধ বাকওয়াজ ব্যাপার-পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর ইনডাইরেক্ট রাজাকাররা বলতো-কোনকিছুর সশস্ত্র সমাধান সমাধান নয় র্মাকা মানবাধিকার ইত্যাদি ভুগিচুগি। তখন তারা হ্যাশট্যাগ পয়দা করতো #বীর_বাঙ্গালি_অস্ত্র_ছাড়ো_মাথায়_একটু_বুদ্ধি_আনো মার্কা কিছু একটা।
তখন শুরু হতো সীমাহীন দলাদলি। মাঝখানে পড়ে তেজী বাঙ্গালির তেজ এক্কেরে ফুট্টুস। একবার তারা এইখানে লাইক দিবে,একবার ওইখানে লাইক দিবে-অস্ত্র আর কেউ হাতে নিবে না। যুদ্ধ করার তো প্রশ্নই আসেনা।
শেষপর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত হ্যাশট্যাগ হতোঃ #যুদ্ধ_কোন_সমাধান_নয়
এরমধ্যে অবশ্যই মুখ সূচালো করে সেলফি তুলনে ওয়ালারা সেলফি তুলতো।হ্যাপিনেস ইজ-বালুবাসা ইজ-মার্কা স্ট্যাটাস দেনেওয়ালারা স্ট্যাটাস দিতো আর মহামতি 'নিরপেক্ষ' লাইকার-শেয়াররা দুইপক্ষের স্ট্যাটাস শেয়ার আর লাইক দিয়ে বেড়াতো।
মাঝখানদিয়ে আমাদের সাধের মুক্তিযুদ্ধটা '#মুক্তিযুদ্ধ' ধরণের ইন্টারনেটের একটা কোনে একটা স্তোকবাক্য হয়েই পড়ে থাকতো।
যদি কারো মনে হয়ে থাকে যে আমি কথাটি বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলছি তাহলে তাদের জন্য সমবেদনা এবং চক্ষু হাসপাতালে ঘুরে আসার পরামর্শ থাকলো।
আমরা জাতিগতভাবে এখন তিনটি ধারায় ভাগ হয়ে গেছি। একটি ধারা হলো মুখ সূচালো সেলফিওয়ালা এক্সপোর্ট কোয়ালিটি প্লাস্টিক। দ্বিতীয় ধারা হলো মহাবুঝদার চরমপন্থী। এদের কাজ ডানদিকে বা বামদিকের চরম চরম গরম গরম কথাবার্তা লিখে ফেইসবুক গরম রাখা। তৃতীয় ধারা হলো নিরপেক্ষ সেলেব্রিটি-যারা এই সবকিছুর ঊর্ধে থেকে এমন এমন লুতুপুতু-কুতুকুতু কথাবার্তা লেখার চেষ্টা করেন,যাতে করে কেউ চেতে না যায় আর সবাই লাইকও দেয়।
আমি নিশ্চিত টিএসসির সেই ঘটনার দিন এই তিন ধারার প্রত্যেক ধারার একমুঠো করে মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউই খুনীদের ধরার জন্য আগাননাই কারণ সবাই অনেক বেশি প্রোফাইল সচেতন। সবাই বিতর্ক করতে চান কিন্তু কেউ বিতর্কে জড়াতে চান না।কাজেই কেউই খুনিগুলোকে ধরতে সামনে এগোলেন না।
এগোলেন কারা? এই তিন চমৎকার ধারার থেকে সিস্টেমেটিক্যালি দূরে ঠেলে দেয়া তৃতীয় লিঙ্গের কিছু 'মানুষ'। যাদের পাবার কিছু নেই-হারাবার কিছু নেই-শুধু বুকের ভিতর এখনো হৃদপিন্ডটি রয়ে গেছে।
আর আমরা পরদিন পেপারে ছাপলাম যে খুনিদেরকে হাতেনাতে ধরেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু হিজড়া।
এরকম একটা সময় আমাদের আত্মোপলব্ধির একটি সুযোগ করে দেয়। আমরা কারা,আর আমরা নিজেদেরকে যাদের থেকে সযত্নে আলাদা করে রেখেছি তারাই বা কারা?
আমরা যাদের বিকৃত মানুষ বলে মনে করে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের চমৎকার মনে করছি,প্রকৃতপক্ষে তাদের মনুষ্যত্বই আমাদের চেয়ে বেশি নয় কি?
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বংশধরের শরীরে আমরা কারা বাস করছি?
আসলেই কি আমরা বীরপ্রসূ বাংলার সন্তান?আমাদের পরিচয় কি?আমরা কি আদৌ মানুষ?
নাকি সেলফি কুইন আর জ্ঞানতাপস আর ফেবু সেলেব্রিটি হতে গিয়ে আমরা গোড়ার মানবতাটুকুই ভুলে গেছি?
মানুষ হয় আশায়-ভালোবাসায়-সহমর্মীতায়-সাহসে-একতায়।আমরা যে ছন্নছাড়া জীবে পরিণত হয়েছি তার ভিতরে এর ছিটেফোঁটাও নেই।
আমার মনে হয় নপুংসকদের হিজড়া বলার আগে আমাদের একবার আয়নার দিকে তাকাবার সময় এসেছে।নপুংসকদের হিজড়া না ডেকে আমাদের আশেপাশে যারা সারাদিন তিলার্ধ বিষয় নিয়েও বিতর্ক করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে কিন্তু সুকৌশলে গা বাঁচিয়ে বিতর্ক এড়িয়ে চলে তাদেরকে হিজড়া বলে ডাকার সময় এসেছে।
নিজের এবং নিজেদের সমষ্টিগত অক্ষমতা আর কাপুরুষতার দিকে তাকিয়ে ঘৃণাভরে বলার সময় এসেছে-শালার হিজড়া!
রাস্তায় তারা প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। তারা নপুংসক।প্রকৃতির আজব খেয়ালে তারা সবচেয়ে সংখ্যাগুরু দুই লিঙ্গের কোন একটি লিঙ্গের অংশ হিসেবে পৃথিবীতে জন্মায়নি।
নব্য সভ্যতার অন্যতম শিক্ষা হলো সংখ্যালঘুকে এক কোণে ঠেলে দেয়া। আর নপুংসকেরা তো সংখ্যালঘুরও সংখ্যালঘু। কাজেই সবার থেকে লাথি ঝাঁটা খেয়ে এসে কোন সংখ্যালঘু এদেরকেও আরেকটা লাথিটা-ঝাটাটা মারতে পারে।
বাংলাদেশের সমাজেও আমরা এই সভ্যতা খুব চমৎকারভাবে অনুসরণ করে আসছি বলে আমরা সংখ্যালঘু নপুংসকদের এমন কোণঠাসার কোণঠাসা করেছি যে সমাজে আজ তাদের কোন স্থান নেই। তাদের শিক্ষার নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই,স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই,সোজা কথা তাদের অস্তিত্ব নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তাদের প্রতি আমাদের সমাজের সংগঠিত একটি ভীতি এবং বিতৃষ্ণা আছে । দুঃখজনক হলেও সত্য,এই ভীতি আর বিতৃষ্ণা বেঁচে তারা জীবিকা উপার্জন করে এবং তাদের বেঁচে থাকার আর কোন-ই বিকল্প নেই আর এই বিকল্পহীনতার জন্য কোনভাবেই তারা দায়ী নয়।
তবু আমরা কথ্য ভাষায় এই নিতান্ত নিরুপায়,অসহায় এবং দুঃখী নপুংসকদের হিজড়া বলে ডাকি এবং একইসাথে তাদের পরিচয় টেনে এই হিজড়া শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করি। আমি এই তথ্য খুব কাছের থেকে জানি কেননা কয়দিন আগে 'পুরুষ হয়েও নারীদের পক্ষ নিয়ে লেখা' একটি প্রবন্ধের কারণে আমাকে এই গালিটি শুনতে হয়েছে।
অথচ হিজড়া শব্দটির শাব্দিক উৎপত্তিস্থল অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ নপুংসক নয়। এটি একটি প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় ভাষা 'কান্নাড' থেকে উৎপন্ন এবং শব্দটি আসলেই একটি গালিবাচক শব্দ। এই শব্দের অর্থ হলো অক্ষম বা কাপুরুষ-অর্থাৎ ভীতু।
কিন্তু আজই একটি সংবাদ চোখে পড়লো এবং আমি নিশ্চিত যে সবারই চোখে পড়েছে। তা হলো-একজন মানুষকে কুপিয়ে মেরে ফেলে পালানোর সময়ে দুইজন খুনিকে কয়েকজন নপুংসক মিলে তাকে জাপটে ধরে থামিয়ে দিয়েছিলো। মনে রাখবেন,খুনিদের হাতে ছিলো ধারালো রক্তাক্ত ধারালো অস্ত্র আর তারা নিজেরা ছিলো নিরস্ত্র। তারপরও তারা সাহস করে খুনিদের পথ রুখে দেয়।
একই কায়দায় একই রকম আরেকটি হত্যাকান্ড কিছুদিন আগে ঘটে গেছে দেশের প্রাণকেন্দ্র টিএসসিতে। সেখানেও হাজার হাজার মানুষের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে একজন মানুষকে হত্যা করা হয় এবং তার স্ত্রীকে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়। টিএসসি বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধরা হয় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন আর সেই এলাকার মানুষদের মনে করা হয় সবচেয়ে সাহসী মানুষ। এরাই একসময় দেশের জন্যে রক্ত দিয়েছে আর দেশের জন্য শহীদ হয়েছে। সেই তাদের সামনে যখন এমন একটি ঘটনা ঘটে যায়,তাদের থেকে একজনও সামনে আগায় না,হত্যা থামানোর চেষ্টা করেনা।
এমন একটা পরিস্থিতিতে যদি আমি অক্ষম কাপুরুষ অর্থে হিজড়া শব্দটি ব্যবহার করতে চাই,তবে আমার কার ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যবহার করা উচিত?
কয়েকদিন আগে খুব কাছের একজন মানুষের সাথে আলোচনা হচ্ছিল যে এই মুহুর্তে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হলে কি হতো?আলোচনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম যে-এই মুহুর্তে যদি বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ হতো তাহলে সবাই তাড়াতাড়ি ফেসবুকে লগইন করে প্রথমে যুদ্ধের সপক্ষে একটা স্ট্যাটাস দিতো। সাথে সাথে পুরো নিউজফিড মুক্তিযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ মার্কা একটা স্ট্যাটাসের জোয়ারের বন্যায় ভেসে যেত।
চারিদিকে দেখা যেতো- #বীর_বাঙ্গালি_অস্ত্র_ধরো
কাজেই কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা মেইনস্ট্রীম মনে করে কিছু মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলা শুরু করতো।এদের মধ্যে থাকতো দুই পার্টি-এক পার্টি ডাইরেক্ট রাজাকার,আরেক পার্টি ইনডাইরেক্ট রাজাকার ওরফে সুশীল। ডাইরেক্ট রাজাকাররা বলতো মুক্তিযুদ্ধ বাকওয়াজ ব্যাপার-পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর ইনডাইরেক্ট রাজাকাররা বলতো-কোনকিছুর সশস্ত্র সমাধান সমাধান নয় র্মাকা মানবাধিকার ইত্যাদি ভুগিচুগি। তখন তারা হ্যাশট্যাগ পয়দা করতো #বীর_বাঙ্গালি_অস্ত্র_ছাড়ো_মাথায়_একটু_বুদ্ধি_আনো মার্কা কিছু একটা।
তখন শুরু হতো সীমাহীন দলাদলি। মাঝখানে পড়ে তেজী বাঙ্গালির তেজ এক্কেরে ফুট্টুস। একবার তারা এইখানে লাইক দিবে,একবার ওইখানে লাইক দিবে-অস্ত্র আর কেউ হাতে নিবে না। যুদ্ধ করার তো প্রশ্নই আসেনা।
শেষপর্যন্ত সর্বজনস্বীকৃত হ্যাশট্যাগ হতোঃ #যুদ্ধ_কোন_সমাধান_নয়
এরমধ্যে অবশ্যই মুখ সূচালো করে সেলফি তুলনে ওয়ালারা সেলফি তুলতো।হ্যাপিনেস ইজ-বালুবাসা ইজ-মার্কা স্ট্যাটাস দেনেওয়ালারা স্ট্যাটাস দিতো আর মহামতি 'নিরপেক্ষ' লাইকার-শেয়াররা দুইপক্ষের স্ট্যাটাস শেয়ার আর লাইক দিয়ে বেড়াতো।
মাঝখানদিয়ে আমাদের সাধের মুক্তিযুদ্ধটা '#মুক্তিযুদ্ধ' ধরণের ইন্টারনেটের একটা কোনে একটা স্তোকবাক্য হয়েই পড়ে থাকতো।
যদি কারো মনে হয়ে থাকে যে আমি কথাটি বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলছি তাহলে তাদের জন্য সমবেদনা এবং চক্ষু হাসপাতালে ঘুরে আসার পরামর্শ থাকলো।
আমরা জাতিগতভাবে এখন তিনটি ধারায় ভাগ হয়ে গেছি। একটি ধারা হলো মুখ সূচালো সেলফিওয়ালা এক্সপোর্ট কোয়ালিটি প্লাস্টিক। দ্বিতীয় ধারা হলো মহাবুঝদার চরমপন্থী। এদের কাজ ডানদিকে বা বামদিকের চরম চরম গরম গরম কথাবার্তা লিখে ফেইসবুক গরম রাখা। তৃতীয় ধারা হলো নিরপেক্ষ সেলেব্রিটি-যারা এই সবকিছুর ঊর্ধে থেকে এমন এমন লুতুপুতু-কুতুকুতু কথাবার্তা লেখার চেষ্টা করেন,যাতে করে কেউ চেতে না যায় আর সবাই লাইকও দেয়।
আমি নিশ্চিত টিএসসির সেই ঘটনার দিন এই তিন ধারার প্রত্যেক ধারার একমুঠো করে মানুষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের মধ্যে কেউই খুনীদের ধরার জন্য আগাননাই কারণ সবাই অনেক বেশি প্রোফাইল সচেতন। সবাই বিতর্ক করতে চান কিন্তু কেউ বিতর্কে জড়াতে চান না।কাজেই কেউই খুনিগুলোকে ধরতে সামনে এগোলেন না।
এগোলেন কারা? এই তিন চমৎকার ধারার থেকে সিস্টেমেটিক্যালি দূরে ঠেলে দেয়া তৃতীয় লিঙ্গের কিছু 'মানুষ'। যাদের পাবার কিছু নেই-হারাবার কিছু নেই-শুধু বুকের ভিতর এখনো হৃদপিন্ডটি রয়ে গেছে।
আর আমরা পরদিন পেপারে ছাপলাম যে খুনিদেরকে হাতেনাতে ধরেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত কিছু হিজড়া।
এরকম একটা সময় আমাদের আত্মোপলব্ধির একটি সুযোগ করে দেয়। আমরা কারা,আর আমরা নিজেদেরকে যাদের থেকে সযত্নে আলাদা করে রেখেছি তারাই বা কারা?
আমরা যাদের বিকৃত মানুষ বলে মনে করে দূরে সরিয়ে রেখে নিজেদের চমৎকার মনে করছি,প্রকৃতপক্ষে তাদের মনুষ্যত্বই আমাদের চেয়ে বেশি নয় কি?
বাংলাদেশে জন্ম নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ বংশধরের শরীরে আমরা কারা বাস করছি?
আসলেই কি আমরা বীরপ্রসূ বাংলার সন্তান?আমাদের পরিচয় কি?আমরা কি আদৌ মানুষ?
নাকি সেলফি কুইন আর জ্ঞানতাপস আর ফেবু সেলেব্রিটি হতে গিয়ে আমরা গোড়ার মানবতাটুকুই ভুলে গেছি?
মানুষ হয় আশায়-ভালোবাসায়-সহমর্মীতায়-সাহসে-একতায়।আমরা যে ছন্নছাড়া জীবে পরিণত হয়েছি তার ভিতরে এর ছিটেফোঁটাও নেই।
আমার মনে হয় নপুংসকদের হিজড়া বলার আগে আমাদের একবার আয়নার দিকে তাকাবার সময় এসেছে।নপুংসকদের হিজড়া না ডেকে আমাদের আশেপাশে যারা সারাদিন তিলার্ধ বিষয় নিয়েও বিতর্ক করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে কিন্তু সুকৌশলে গা বাঁচিয়ে বিতর্ক এড়িয়ে চলে তাদেরকে হিজড়া বলে ডাকার সময় এসেছে।
নিজের এবং নিজেদের সমষ্টিগত অক্ষমতা আর কাপুরুষতার দিকে তাকিয়ে ঘৃণাভরে বলার সময় এসেছে-শালার হিজড়া!